ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) নবী প্রেমে উৎসর্গিত এক মহান ব্যক্তিত্ব
কোন পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আর সাগর বুকের হিল্লোলের মাঝেও যদি ইসলামের ও মুসলমানের ইতিহাস কেউ লিখতে বসে, সেও বাধ্য হবে তাঁর লিখনীতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নাম লিখতে। কারণ তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম খলীফা। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সেই মহান বক্তিত্ব, ইতিহাসে যার নাম মহান ত্রাণকর্তা হিসেবে স্বার্ণক্ষরে লিখিত। নবীদের পর সমগ্র বিশ্বে মানুষের উপর যার অবস্থান তিনিই সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে জানবাজি রেখে যিনি নিরলস সেবা দিয়ে সারাজীবন পরিশ্রম করেছেন তিনিই হযরত আবু বকর সিদ্দক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। দয়া-দানশীলতায় কোনদিক যাকে পেছনে ফেলতে পারেনি কেউ, ইসলাম গ্রহণেও তিনি অগ্রগণ্য। বাল্যকাল, যৌবনকাল, বৃদ্ধকাল এমনকি কবর জীবনও যিনি রাহমাতুল্লিল আলামীনের সঙ্গলাভে ধন্য। সেই মহান ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মুসলিম মিল্লাতের অনুসরণীয় আদর্শ। বক্ষমান লিখনীতে তাঁর সাফল্যভরা বিশাল জীবনীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক আলোকপাত করার প্রয়াস পাব।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কেমন ছিলেন
হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কখনো মুর্তি পূজা করেননি। মাত্র চার বছর বয়সে একদিন তাকে তাঁর পিতা আবু কূহাফা মূর্তি ঘরে (মন্দির) নিয়ে গিয়ে বলল- এরা তোমার প্রভূ । তুমি এদের প্রনাম করো। [সূত্র. ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী] চার বছরের শিশু আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে মূর্তিদের একেবারে নিকটে গিয়ে বললেন যদি তোমরা খোদা (প্রভু) হও তাহলে আমি তোমাদের কাছে কতিপয় আবেদন করছি। আমি খুবই ক্ষুধার্ত, আমাকে খাবার দাও। আমার কাপড় নেই, আমাকে কাপড় দাও। আবেদনের পর কোন জবাব কিংবা শব্দ না পেয়ে এবার আস্ত পাথর হাতে নিয়ে সম্বোধন করলেন, যদি সত্যি তোমরা খোদা হও তাহলে আমার আক্রমণ থেকে তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করো। দেখা গেল এতেও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আর দেরি না করে ছুড়ে মারলেন সেই প্রস্তরখণ্ড; মূর্তির নাক- মুখ ভেঙ্গে চৌচির। এদিকে ছেলের এমন কাণ্ড দেখে বাবা যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কাল বিলম্ব না করে সজোরে মেরে দিল এক থাপ্পড়। দ্রুত ছেলেকে স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে ঘটনা খুলে বলল। ঘটনা শুনে স্ত্রী রহস্যের দ্বার উম্মোচন করলেন। আর বললেন ওহে স্বামী! এই শিশুকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। কোন ধরনের বাড়াবাড়ি কিংবা চাপ প্রয়োগ করা শুভ হবে না মনে হয়। এই শিশুর প্রসবকালীন সময়ের কথা বলছি। সেইদিন আমি এক গায়েবী ওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম – হে আল্লাহর বান্দেনী তোমাকে নরকের আগুনের শাস্তি হতে মুক্ত এবং সুসন্তানের শুভ সংবাদ দেয়া হচ্ছে। যার নাম আসমানে মধ্যে সিদ্দিক; আর তিনি হবেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথী এবং বন্ধু। [সূত্র. ইরশাদুস সারী ৬ষ্ঠ খন্ড ১৮৭ পৃষ্ঠা] পরবর্তীতে কোন এক সময় এসব ঘটনা স্বয়ং আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা এর সামনে বর্ণনা করেছিলেন- হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, সেদিন সিদ্দিকে আকবার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তার কথা শেষ করার পর পরই হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম নবীজির দরবারে হাজির হয়ে বললেন এতক্ষণ আবু বকর সিদ্দিক যা বলেছেন সত্যই বলেছেন। [সূত্র. প্রাগুক্ত]
নবীজির একান্ত সঙ্গী
ইসলাম গ্রহণের পর প্রায় সারাক্ষণ নবীজির দরবারে পড়ে থাকতেন। কি যুদ্ধ, কি সফর সব কর্মসূচিতে সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অবস্থান থাকতো নবীজির সান্নিধ্যে। আর গোপনে মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে লাগলেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প দিনেই প্রসিদ্ধ কিছু লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আবদ্ধ হন। হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত যুবাইর ইবনে আওয়াম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযতর আবদুর রহমান ইবনে আউফ, হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, হযরত তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম প্রমুখ সাহাবী তারই দাওয়াতে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হন।
[যুরকানী আলাল মাওয়াহেব ১ম খন্ড ২৪৬ পৃষ্টা]
ইসলাম প্রচারে প্রথম ওয়াজ মাহফিল
মুসলামানদের সংখ্যা যখন ২৮ জন হয়ে গেল তখন সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীজির কদমে আবেদন জানালেন হুজুর! এখনতো আমরা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিতে পারি। সমাজ, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে প্রজ্ঞাবান প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্দিকে আকবরকে আরো কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এখনো মুসলমানের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাত দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। কিন্তু ইসলামের প্রতি প্রবল আগ্রহ অগাধ শ্রদ্ধা, গভীর ভালবাসার কারণে সিদ্দিকে আকবর একবার নয়, বারবার অনুমতি চাওয়ার ফলে তিনি অনুমতি দিলেন। এটাই ইসলামের প্রচারের প্রথম সমাবেশ। যখনই সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু লোকদেরকে আল্লাহ-রাসূলের প্রতি দাওয়াত দিলেন উপস্থিত কাফির মুশরিকরা চারদিকে হতে বৃষ্টির মত পাথর হামলা করতে লাগল। উপর্যুপরি হামলায় তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। চেহারা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। পরিশেষে তার গোত্রের কিছু লোক এগিয়ে এলে কাফির মুশরিকরা পালিয়ে যায়। উদ্ধারকারীরা একটি চাদরে আবৃত করে গুরুতর আহত অবস্থায় সিদ্দিকে আকবরকে ঘরে পৌছে দেন। তখন এত বেশী আহত হয়েছিল- বনী তামিম গোত্রের লোকদের প্রবল ধারণা হয়েছিল যে, সিদ্দিকে আকবরের মৃত্যু নিশ্চিত। জর্জরিত শরীর নিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বেহুশ হয়ে যাচ্ছিলেন। মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনেরা অনেক চেষ্টা করেও কথা বলাতে পারলনা। অনেকক্ষণপর হঠাৎ হুশ ফিরে আসলে কোনমতে কথা বলার শক্তি পেয়ে গেলেন। এ সুযোগে আশে-পাশের উপবিষ্ট লোকদের কাছে জানতে চাইলেন তোমরা আমাকে আগে বলো আমার প্রিয় নবীর কি অবস্থা? তিনি ভাল আছেন তো? অক্ষত আছেন তো? এমন কঠিন বিপদ এবং নাজুক মুহূর্তেও নবীজির কথা ভুলতে পারেননি। বনী তামীম গোত্রের লোকেরা তখনও ঈমান না আনার কারণে সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর কথাগুলো পছন্দ হলোনা। তাই রাগ এবং অভিমান করে সবাই চলে গেলেও মা ছেলেকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না। একমাত্র মা-ই সিদ্দিকে আকবরের পাশে বসে কাঁদছেন আর আদর করে জিজ্ঞাসা করছেন, বেটা! তুমি কী খাবে? কী দেব তোমাকে? কিন্তু সিদ্দিকে আকবরের একটিই আবেদন- আম্মা! বরং তুমি আমাকে আমার নবীর খবরটা সংগ্রহ করে দাও। আমার জানতে বড় মন চাচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় নবীজি কেমন আছেন? উম্মে জামিল বিনতে খাত্তাব তার ঘরে এলে তার কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারলেন যে, নবীজি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং নিরাপদ আছেন। এবার বললেন আমি কসম করে বলছি আমি ততক্ষণ মুখে খাবার দেবনা যতক্ষণ না আমার নবীজিকে সামনে হাজির করাবেনা। তোমরা আমাকে নবীজির দরবারে নিয়ে চলো। পরিশেষে মা ছেলে আবু বকর সিদ্দিককে নিয়ে অনেক কষ্টে নবীজির দরবারে হাজির হলেন। এদিকে নবীজি স্বয়ং বন্ধু আবু বকরকে এক নজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। ঠিক মুহূর্তে প্রাণপ্রিয় সাহাবীর উপস্থিতিতে নবীজি যেন হারানো মানিক ফিরে পেলেন। এগিয়ে এসে অতি মহব্বতে আবেগ নিয়ে তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কপালে উপর্যুপরি চুম্বন দিতে লাগলেন। আর সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীজির দরবারে আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা তাঁর ছেলের উপর দয়াবতী আপনার মোবারক দোয়া হলে আল্লাহ পাক তাকে জাহান্নামের স্থায়ী আগুন থেকে রক্ষা করবেন। সিদ্দিকে আকবরের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ফরিয়াদ শেষে হওয়ার পৃর্বেই দেখতে পেলেন তার আম্মাজান নবীজির উপর কালিমা শরীফ পড়ে ইসলামের পতাকাতলে শামিল হয়ে গেলেন এবং বেহেশতের ঠিকানা নিশ্চিত করে নিলেন।[হায়াতুস সাহাবা ২য় খন্ড ২৯০ পৃষ্ঠা]
সকল বিষয়ে প্রথম
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রেই প্রথম ছিলেন – এমনটি নয়; বরং ইসলামের দাওয়াত প্রচার, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা, গোলাম আজাদ করা, ইবাদত বন্দেগী নবীজির খিদমতসহ প্রতিটি ভাল কাজে তিনি ছিলেন সবার অগ্রে। হযরত উম্মুল মুমিমীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আব্বাজান আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীজির খেদমত ৪০ হাজার (তৎকালিন) দেরহাম খরচ করেছিলেন। তিনি যেদিন ইন্তেকাল করেছিলেন সেদিন তার কাছে কোন দিনারও ছিলনা, কোন দেরহামও ছিলনা। [ফতহুল বারী ৭ম খন্ড ১১ পৃষ্ঠা] তাবুক যুদ্ধের খরচের জন্য নবীজি সাহাবীদের কাছে চাঁদা সংগ্রহের ঘোষণা দিলেন। সমস্ত সাহাবী স্ব-স্ব সামর্থানুসারে উক্ত ডাকে সাড়া দিলেন। হযরত ফারুকে আজম ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ভাগ্যিস আমার কাছে ঐদিন সকল প্রয়োজনীয় মুহূর্তেও চেয়েও সম্পদের পরিমাণ বেশী ছিল। আবু বকর সিদ্দিকের পরিমাণ কোন কারণে অল্প ছিল। সুতরাং আজকে আমার মোক্ষম সুযোগ। আজ এমন ভাবে আল্লাহর রাস্তায় দান করবো যাতে হযরত সিদ্দিকে আকবরের উপর অগ্রগামী হয়ে যাবো। কারণ সব সময় তিনি প্রথম স্থানে থাকেন। কালবিলম্ব না করে ঘরে গিয়ে সমস্ত সম্পদেকে দু’ভাগে ভাগ করে অর্ধেক রেখে দিলেন, বাকী অর্ধেক সম্পদের বিশাল বহর নিয়ে নবীজির কদমে এনে হাজির করে দিলেন। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন ওমর! ঘরে কি রেখে এসেছ? উত্তরে বললেন, হুজুর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক নিয়ে এসেছি বাকিটা রেখে এসেছি। এদিকে সিদ্দিকে আকবরও ঘরে যা কিছু ছিল এমনকি চুলার ছাই পর্যন্ত সব কিছু একটা ঝুড়িতে করে নবীজির খেদমতে হাজির করলে নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন আবু বকর তুমি কি নিয়ে এসেছ? উত্তরে বললেন হুজুর এবার তেমন কোন সম্পদ ছিলনা তাই পরিমাণটা কম হয়েছে । তবে ঘরে যা পেয়েছি সবই নিয়ে এসেছি আর পরিবার পরিজনের জন্য আল্লাহ এবং তার রাসূলকে রেখে এসেছি। উত্তর শুনে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ উপস্থিত সবার চোখ যেন কপালে ওঠে গেল। আর এক বাক্যে সবাই স্বীকার করে নিলেন ইসলামের খেদমতে হযরত সিদ্দিকে আকবরই সব বিষয়ে প্রথম। [মেশকাত শরীফ ৫৫৬ পৃষ্ঠা]
নবীর মহব্বতে জন্মভূমি ত্যাগ
ইসলামের মহান ত্রাণকর্তা হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীর মুহব্বতে কেবল মাল সম্পদ ত্যাগ করেছেন এতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং নিজের মাতৃভূমির মায়া আত্মীয় স্বজনের মায়া পর্যন্ত ত্যাগ করে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মুসলমানদের উপর কুরাইশদের অত্যাচার জুলুমের মাত্রা বেড়ে গেলে কিছু কিছু মুসলমান সহ্য করতে না পেরে হাবশায় হিজরত করেন আবার কিছু কিছু মদীনা মনোয়ারায় চলে যান। তাই হাতে গোনা কয়েকজন মুসলমান ছাড়া আর কেউ ছিলনা। সুযোগ বুঝে কাফের মুশরিকরা নবীজির বিরুদ্ধে নতুন মাত্রা শুরু করল। এমনকি তাকে হত্যা করার মত দুঃসাহসিক নীল নকশাও তৈরি করা হলো। তাই একদিন হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম মারফত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীজিকে মদীনা শরীফ হিজরতের নির্দেশ প্রদান করেন। মহান আল্লাহর নির্দেশে কথা জানালে সিদ্দিকে আকবরও নবীজির সাথে হিজরতের আবেদন জানালে নবীজি বললেন ঠিক আছে তুমি প্রস্তুত থেকো। আমি যাওয়ার সময় তোমাকে ডেকে নেব।
হিজরতের জন্য অপেক্ষা
নবীজির সম্মতি পেয়ে সিদ্দিকে আকবর দিনের বেলাতো বটে, রাত্রের বেলায়ও এ অপেক্ষার প্রহর গুনতেন এমনকি বিছানায় শুয়ে ঘুমকে নিজের জন্য নিষিদ্ধ করে নিলেন। এভাবে দিন রাত পার করে দিয়েছিলেন আর কান পেতে অপেক্ষা করছেন কখন নবীজির নূরানী জবান থেকে ডাক আসবে। এদিকে একরাত্রে কাফের মুশরিকরা নবীজির পবিত্র আস্তানার চতুর্দিকে ঘেরাও করে ফেললো। আর ঐ রাতে হিজরত করার জন্য আল্লাহ পাকের চূড়ান্ত নির্দেশ নিয়ে জিবরাঈল আমিন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলেন। ঐ রাতে হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীজির দরবারে ছিলেন। নবীজি তাকে বললেন- আলী তুমি আমার বিছানায় শুয়ে থাক, আর আমি মদীনায় হিজরত করলাম। বাইরে শত্রুরা ওঁৎপেতে বসে রয়েছিল । কখন নবীজি ঘর থেকে বের হচ্ছেন। নবীজি ঘর থেকে বের হয়ে সূরা ইয়াছিনের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে হাতের মুষ্টিতে ধুলো-বালি নিয়ে শত্রুদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন এতে ধুলাকণাগুলো প্রত্যেকের চোখের ভিতরে গিয়ে পৌছে গেল তারা চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে মাটিতে বসে পড়ল। নবীজি তাদের সামনে চলে গেলেন, তারা দেখতেই পেলনা। এভাবে নবীজি আবু বকরের বাড়ির আঙ্গিনায় গিয়ে ডাক দিলেন! হে আবু বকর! প্রথম ডাকেই সিদ্দিকে আকবর বলে দিলেন “লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ”। নবীজি আমি হাজির,নবীজি প্রশ্ন করলেন এত গভীর রাতে তুমি কিভাবে সাড়া দিলে? উত্তরে সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে দিন আপনি আমাকে হিজরতের কথা বলেছিলেন সে দিন থেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমানো বাদ দিয়ে দিয়েছি। সারারাত দরজার পাশে কান লাগিয়ে দিয়ে আপনার ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ, একবারের জায়গায় যদি কয়েকবার ডাকতে হয় তাহলে আপনার কষ্ট হবে। তা আমার জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এবার ছুটে চললেন দু’জনেই মদীনা মনোয়ারার পানে। মক্কা মোকাররমার তিন মাইল দূরে সুর পর্বতের অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গুহার নিকটবর্তী হলেন। নবীজি বললেন, আমরা গুহার অভ্যন্তরে অবস্থান নিই, যাতে শত্রু আমাদেরকে না দেখে। কারণ, দিনে তারা আমাদের পিছু নেবে নিশ্চয়।
সূর পর্বতের গুহায় অবস্থান এবং সিদ্দিকে আকবরের সর্বোচ্চ ত্যাগ
নবীজির পক্ষ হতে “গারে সূরে” অবস্থানের কথা শুনে হযরত সিদ্দিকে আকবর আরজ করলেন। নবীগো! আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি গুহার অভ্যন্তরে গিয়ে দেখি এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করি। গুহার ভিতরে গিয়ে দেখা গেল ছোট ছোট অনেক গর্ত যেন সব বিষাক্ত সাপ আর বিচ্ছুর বাসা। সিদ্দিকে আকবর নিজের গায়ের চাদর ছিড়ে প্রত্যেকটা গর্তের মুখ বন্ধ করে দিলেন কিন্তু কাপড়ের অভাবে আরেকটা গর্ত বন্ধ করা সম্ভব হলনা তাই ঐ গর্তের মুখে নিজের পা বসিয়ে দিলেন আর বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! এবার প্রবেশ করুন। তারপর নবীজি গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন এবং সিদ্দিকে আকবরের কোলে মাথা মোবারক রেখে বিশ্রাম নিতে লাগলেন।
[সূত্র- মিশকাত শরীফ -৫৫৬ পৃষ্ঠা] নবীজি যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন এক বিষধর সাপ গুহার অভ্যন্তরে প্রতিটি গর্তের মুখ বন্ধ দেখে সর্বশেষ সিদ্দিকে আকবরের পা দিয়ে আটকানো গর্তের মুখে এসে বের হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সিদ্দিকে আকবরের পায়ে এক কামড় দিল। প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করার পরও অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। কোন ধরনের নড়াচড়া করলেন না, যেন নবীজির ঘুম ভেঙ্গে না যায়। কিন্তু পাহাড়িয়া বিষধর সাপের বিষের প্রভাবে সমস্ত শরীর আস্তে আস্তে কালো হয়ে ওঠলো, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি বেরিয়ে এলো। এক ফোঁটা পানি রাসূলের চেহারার উপর গিয়ে পড়ল। [সূত্র – মিশকাত শরীফ -৫৫৬ পৃষ্ঠা] নবীজি চোখ খুললেন আর সিদ্দিকে আকবরের এহেন নাজুক অবস্থা দর্শনে জিজ্ঞাসা করলেন হে আবু বকর! কী হয়েছে তোমার? উত্তরে বললেন,সাপ কামড় দিয়েছে। নবীজি বললেন চিন্তার কোন কারণ নেই। এক্ষুনি চিকিৎসা হয়ে যাবে। এই বলে মুখের থুথু মোবারক সিদ্দিকে আকবরের শরীরে লাগিয়ে দিতেই সমস্ত শরীরের বিষ মুহূর্তের মধ্যেই পানি হয়ে গেল। অবশেষে মদীনা মুনাওয়ারায় পৌছে ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। হিজরতের পর দীর্ঘ দশ বছর নবীজির সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সিদ্দিকে আকবরের জীবনের অন্যতম দিক।
খেলাফত লাভ
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের সময় সরাসরি খলীফা মনোনীত করে না গেলেও পূর্বেকার কতিপয় ঘটনা ও হাদীস শরীফে সিদ্দিকে আকবরের খেলাফতের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন নবীজি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন মসজিদে নববীর ইমামতির দায়িত্ব সিদ্দিকে আকবরের উপর অর্পণ করা হয়েছিল। তাছাড়া একদা কোন এক মহিলা রাসূলের দরবারে এসে কোন একটি বিষয়ে জানতে চাইলে নবীজি ঐ মহিলাকে পরবর্তীতে আসার নির্দেশ দেন। মহিলা আবেদন করল আগামীবার এসে যদি আপনাকে না পাই? উত্তরে নবীজি বললেন – আমাকে না পেলে আবু বকরের কাছে গিয়ে জেনে নিও”।
[সূত্র. বুখারী ও মুসলিম শরীফ] ইন্তেকাল
হিজরি ১৩ সনের জমাদিউল উখরা মাসে সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ডেকে বললেন, আমার যখন ইন্তেকাল হয়ে যাবে তখন তোমার সেই হাত দিয়ে গোসল দিও যে হাত দিয়ে প্রিয় নবীকে গোসল দিয়েছ। অতঃপর সুগন্ধি লাগিয়ে লাশ কাফন পরিধান করে নবীজির রওজা পাকের সামনে নিয়ে রেখে দিও আর নবীজির দরবারে আবেদন করিও ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার বাল্যবন্ধু, যৌবনকালের বন্ধু এবং হিজরতের সাথী আজ আপনার কদমে হাজির। এতে যদি সাড়া পাওয়া যায় তাহলে আমাকে সেখানে দাফন করবে; অন্যথায়, জান্নাতুল বাকীতে (কবরস্থানে) দাফন করে দিও। সিদ্দিক আকবরের ইন্তেকালের পর নির্দেশমত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) লাশ মোবারক রসূলের রওজা পাকের সামনে হাজির করে উল্লেখিত আবেদন করার পর রওজা পাক থেকে স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসল। “আদখিলুল হাবীবা ইলাল হাবীব”। অর্থাৎ তোমরা বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলিয়ে দাও। কারণ, বন্ধুর জন্য বন্ধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।
[সূত্র.খাসাযেসুল কুবরা, কৃত ঃ ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী]
(সংগৃহীত)